টেকনাফে পাহাড় সন্ত্রাসীদের নিকট জিম্মি লক্ষাধিক মানুষ; সেনাবাহিনীর সাঁড়াশি অভিযানের দাবি
কক্সবাজার জেলায় আলোচিত উপজেলার নাম টেকনাফ। মাদক, অপহরণ, মানবপাচার ও হত্যাকাণ্ডের নেপথ্যে জড়িয়ে আছে পাহাড়ি সন্ত্রাসীদের নাম। স্থানীয় প্রভাবশালী মহলের
ছত্রছায়ায় পাহাড়ের চূড়ায় বসে বিভিন্ন অপরাধী কর্মকাণ্ড সংঘটিত করছে পাহাড়ি সন্ত্রাসীরা।
এক সময় যে পাহাড়ের চূড়ায় মানুষের আনাগোনা ছিল, সে পাহাড় এখন অপহরণ বাণিজ্যের আতঙ্কের নাম। নোয়াখালী ঝর্ণায় যেসব পরিবার পিকনিকের আয়োজন করতো সে নোয়াখালী পাহাড়ের হিংস্র মানবদের বাস্তবতা দেখিয়ে কিশোরকে সচেতন করছে পরিবার। এই জনপদের মানুষ স্বজন হারানোর বেদনাকে অনেক আগেই আপন করে নিয়েছে।
রোহিঙ্গা শরণার্থী ক্যাম্পে চাকরির সুবাদে বাংলাদেশের ৬৪ টি জেলার লোক বাস করে টেকনাফে। এখানে কাজ করছে বিভিন্ন এনজিও। অথচ টেকনাফে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি একদম ভেঙে পড়েছে। এই জনপদের লক্ষাধিক মানুষ জিম্মি হয়ে পড়েছে স্থানীয় ও রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীদের কাছে। এসব সন্ত্রাসীদের নির্যাতনে বাহারছড়া ও হ্নীলা ইউনিয়নের সাধারণ মানুষ আতঙ্কিত।
(৩ জানুয়ারি) সন্ধ্যায় টেকনাফের বাহারছড়া বড়ডেইল এলাকার মৃত আব্বাস মিয়া'র ছেলে রাজমিস্ত্রী ছৈয়দ হোছাইনকে অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীরা ফাঁকা গুলিবর্ষণ করে ঘরে ঢুকে মাথায় অস্ত্র ঠেকিয়ে পাহাড়ে নিয়ে গেছে বলে জানিয়েছে তাঁর পরিবার।
স্থানীয় নুর হোসেন বলেন, মাগরিবের পর পাহাড়ি ডাকাতদল এলাকায় নেমে অস্ত্রের মুকে জিম্মি করে একজনকে অপহরণ করে নিয়ে যায়, নিজেরাও এখন নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছি।
এরইমধ্যে, মুদি দোকানী জসীমের কাছ থেকে ১০ লক্ষ টাকা চাঁদা দাবি করছে বলে স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে।
২০২৪ সালের (৩০ ডিসেম্বর) স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী টেকনাফ আগমনের দিন সকালে জাদিমুড়া এলাকার পশ্চিম পাহাড়ে বনবিভাগের ১৯ জন শ্রমিক অপহরণের শিকার হন। এরপরের দিন (৩১ ডিসেম্বর) র্যাব, পুলিশ ও স্থানীয়দের যৌথ অভিযানের মুখে অপহৃতদের ছেড়ে দেন পাহাড়ি দুর্বৃত্তরা। তবে, সেদিন হোয়াইক্যং-শামলাপুর ঢালা থেকে গাড়ি থামিয়ে আরো ৭ জনকে অপহরণ করে পাহাড়ে নিয়ে যায় দুর্বৃত্তরা। যারা (১ জানুয়ারি) মুক্তিপণ দিয়ে ফিরে আসেন।
গত (২৯ ডিসেম্বর) টেকনাফ বাহারছড়ার কচ্ছপিয়া পাহাড়ের উপর আব্দুল আমিনের অস্থায়ী তাবু ঘর থেকে মালেশিয়ায় পাচারকালে ১৮ জন পুরুষ, ১১ জন মহিলা ও ৩৭ জন শিশুসহ মোট ৬৬ জন ভিকটিম উদ্ধার করে পুলিশ। ভিকটিমদের মধ্যে ৭ জন বাংলাদেশী নাগরিক ও বাকি ৫৯ জন রোহিঙ্গা শরনার্থী ক্যাম্পের বাসিন্দা।
এ ঘটনায় ৫ জনকে গ্রেফতার করা হলেও মূলহোতাসহ বেশ কয়েকজন পলাতক রয়েছে। এদের মধ্যে, কচ্ছপিয়া এলাকার আব্দুল আমিন, একই এলাকার কেফায়েত উল্লাহ (২৭), সুলতান আহম্মদ (৩৬), নুর মোহাম্মদ (৪৪), ছৈয়দুল হক (৪০), মোহাম্মদ জয়নাল (২৭), সাবরাং আলীর ডেইল এর আবদুল আমিন (৩৫)।
জানা যায়, ১০ থেকে ১৫ দিন যাবৎ ধাপে ধাপে আসামীরা পরস্পর যোগসাজশে ভিকটিমদের ঘটনাস্থলে আনেন এবং মালয়েশিয়া পাচারের জন্য জোরপূর্বক আটক করে রাখেন।
ভিকটিমদের একজন বলেন, আমি একজন জেলে। আমাকে কাজের কথা বলে আমার এক বন্ধুর মাধ্যমে বাহারছড়া ঘাটে নিয়ে আসেন। এরপর কোম্পানির বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার কথা বলে একটি ঘরে নিয়ে গিয়ে অস্ত্র ধরে বন্ধী করে রাখেন। সেখান থেকে কয়েকজন দালাল আমাদেরকে একটি স্থানে জড়ো করেন।
আরেকজন বলেন, আমরা টেকনাফে বেড়াতে আসছিলাম। সেখান থেকে ধরে নিয়ে গিয়ে আমাকে মারধর করে মোবাইল ও টাকা পয়সা নিয়ে নেয় এবং সাড়ে ৩ লাখ টাকার বিনিময়ে মালেশিয়া পাচার করে দেওয়ার কথা বলে। গতকাল রাতে মালেশিয়ায় পাচার করার জন্য আমাদেরকে ব্যাগ গুছিয়ে নিতে বলেন। আমাদেরকে পরে পুলিশ উদ্ধার করে প্রাণ বাঁচিয়েছেন। এভাবে বর্ণনা দিচ্ছিলেন, শরণার্থী ক্যাম্পের অপহৃত রোহিঙ্গারা।
(২৩ ডিসেম্বর) দুপুর ১ টার দিকে, টেকনাফ সদর মহেশখালীয়া পাড়া ড. গণির বাড়ি সংলগ্ন ব্রীজে নারীকে হেনস্তা করে স্বর্ণ ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটে। হেনস্তার শিকার টেকনাফ সদর পশ্চিম গোদারবিল এলাকার মো. আবদুল্লাহ এর স্ত্রী মুন্নি জানান, আমার জেলে স্বামীকে টেকনাফ বীচ পয়েন্ট মহেশখালীয়া পাড়া ঘাটে খাবার দিয়ে বাসায় ফিরে আসার সময় দুইজন যুবক এসে আমাকে টেনেহিঁচড়ে আমার নাকে থাকা স্বর্ণ ছিনতাই করে নিয়ে যায়। তাদের হাতে চুরি ছিল, আমি চিৎকার করার পরেও আশেপাশে থাকা কেউ ভয়ে আমাকে বাঁচাতে আসেনি। টেকনাফে এরকম ঘটনা অহরহ ঘটছে, কেউ মুখ খুলছে আবার কেউ ভয়ে মুখ খুলে না।
যুগ যুগ ধরে টেকনাফের নেটং পাহাড় ও বাহারছড়া পাহাড়কে জিম্মি করে স্থানীয় এবং রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীরা ব্যবসা করে আসছে। বর্তমানে সাধারণ মানুষের চলাফেরা করতে হয় ভয়ে এবং আতঙ্কে। পাহাড়ি সন্ত্রাসী নিধন করা খুব জরুরি তারা সাধারণ মানুষকে অপহরণ করে পাহাড়ে নিয়ে গিয়ে বাণিজ্য করছে। সরকারের আন্তরিকতায় এই জিম্মি দশা থেকে মুক্ত হতে পারবে টেকনাফ। পাহাড়ি রোহিঙ্গাদের সাথে আঁতাত করে স্থানীয় সন্ত্রাসীরা বিভিন্ন অপরাধী কর্মকাণ্ডে লিপ্ত আছে। টেকনাফের সাধারণ কেটে খাওয়া মানুষ, দিনমজুর কেউ বাদ যায় না অপহরণকারী ডাকাত চক্রের রক্তচক্ষু থেকে। পাহাড়ের পাশে থাকা জমিতে চাষ করতে গিয়ে অপহরণের শিকার হতে হচ্ছে। টেকনাফের মানুষের আয় রোজগারে বাঁধা হয়ে দাঁড়িয়েছে পাহাড়ি শকুনের দল। পাহাড়কে রক্ষা ও সন্ত্রাসমুক্ত করার দাবি তুলেছে স্থানীয় জনসাধারণ।
একসময় টেকনাফে কিলিং বাণিজ্য শুরু হয়েছিল রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী আবদুল হাকিমের হাত ধরে। সে কোথায় এখন কেউ জানে না, তার পতন হয়েছে এমন ধারণা রয়েছে অনেকের, এখন উত্থান হয়েছে আরও কয়েক ডজন রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী হাকিমের। টেকনাফে যুগ যুগ ধরে রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীরা রাজত্ব করছে, তাদের ভাবখানা এখন এমন পর্যায়ে গেছে যে তারা চিরকাল এখানেই থাকবে।
এ বিষয়ে টেকনাফ সাংবাদিক ইউনিটির সাইফুল ইসলাম সাইফী বলেন, প্রতিনিয়ত অপহরূতরা মুক্তিপণ দিয়ে ফিরে আসছে, টেকনাফে প্রশাসনের আইওয়াশ অভিযান চলে। সরকারের রোহিঙ্গা প্রীতি বন্ধ না হলে টেকনাফের মানুষ রোহিঙ্গাদের কাছে জিম্মি হয়েই থাকবে। প্রশাসনের পৃষ্ঠপোষকতায় রোহিঙ্গারা মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে।
চট্রগ্রাম সরকারি মহিলা কলেজের টেকনাফের শিক্ষার্থী তারিন রেহনুমা প্রমি জানান, টেকনাফে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির চরম অবনতি, ভৌগোলিক ভাবে জনমানবশূন্য গহীন বনাঞ্চল ও সমুদ্রতীরবর্তী অঞ্চলে বেকারত্ব বৃদ্ধি এবং রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে টেকনাফে অপহরণ ও মানবপাচারের ঘটনা ঘটছে।
শরণার্থী ক্যাম্পের বাহিরে যাতায়াতে সীমিতকরণ, নিবিড় পর্যবেক্ষণ ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতা বৃদ্ধি করতে হবে। ঝুকিপূর্ণ এলাকায় নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করতে হবে এবং অস্ত্রের উৎস খুঁজে বের করে তা জব্দ করতে হবে। স্থানীয় জনসাধারণের মাঝে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। আইনের যথাযথ প্রয়োগ করতে হবে, সীমান্তে টহল বৃদ্ধি করতে হবে।
টেকনাফে বেকারত্ব নিরসনের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। মাদকের ক্ষতিকর প্রভাব তুলে ধরে মহল্লা ভিত্তিক মাদক নির্মূল কমিটি গঠন করে কার্যকর পরিচালনা করতে হবে। টেকনাফ যেহেতু শিক্ষার হারে পিছিয়ে থাকা উপজেলা সেহেতু জনসচেতনতামূলক মাসিক বা ত্রিমাসিক সভা সমাবেশ করতে হবে।
টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) শেখ এহসান উদ্দিন বলেন, টেকনাফে আমি নতুন এসেছি, অপহরণ ও মানবপাচার কিভাবে রোধ করা যায় এটা নিয়ে ভাবতেছি। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সাথে বসে অপহরণ ও মানবপাচার রোধে সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে।
টেকনাফ এখন খুন-হত্যা, চাঁদাবাজি ও মানবপাচারের লোমহর্ষক বিভীষিকা। সরকার এ ব্যাপারে পদক্ষেপ নিলে পাহাড়ি সন্ত্রাসী নির্মূল করা কোনো কঠিন কাজ নয়। এ অবস্থা থেকে এলাকাবাসী মুক্তি চায়। সেনাবাহিনীর উদ্যোগে পাহাড়ে যৌথ সাঁড়াশি অভিযান পরিচালনা করা সময়ের দাবি এমনটাই মনে করছেন টেকনাফবাসী।


Social Plugin