নাফনদী নির্ভর আয়ের জন্য আধিপত্যের মিশনে ‘আরাকান আর্মি’

# আতংকিত বাংলাদেশী জেলেরা, ২১ দিনে ধরে নিয়ে যাওয়া ৪৬ জনের খোঁজ নেই
মিয়ানমার-বাংলাদেশের সীমান্ত নাফনদীতে নিজেদের আধিপত্য বিস্তারের মিশনে নেমেছে মিয়ানমারের সশস্ত্র বিদ্রোহী গোষ্ঠি আরাকান আর্মি। মিয়ানমারের অভ্যন্তরে দেশটির সেনা বাহিনীর সাথে যুদ্ধ করে রাখাইন রাজ্য নিয়ন্ত্রণের পর ২০২৪ সালের ডিসেম্বর থেকে গোষ্ঠিটি নাফনদীতে নিজের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার অপচেষ্টায় লিপ্ত রয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আরাকান আর্মির নিত্য পণ্য, খাবার সহ প্রয়োজনীয় পণ্য প্রয়োজনের টাকা আয়ের জন্যই এমন অপতৎপরতা চালাচ্ছে।
আরাকান আর্মির সদস্যরা দফায় দফায় বাংলাদেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে নাফনদী থেকে বাংলাদেশী ট্রলার সহ জেলেদের ধরে নিয়ে যাচ্ছে। সর্বশেষ মঙ্গলবারও নাফনদী থেকে আরও ৬ জনকে ট্রলার সহ ধরে নিয়ে গেছে। এ নিয়ে গত ২১ দিনে ৪৬ জনকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। যাদের কোন খবর পাচ্ছে না স্বজনরা।
এতে টেকনাফের নাফনদী ব্যবহার করে সাগরে মাছ ধরা ৪ হাজারের বেশি ট্রলার মালিক সহ জেলেদের মধ্যে চরম আতংক তৈরি হয়েছে।
সর্বশেষ সাগর থেকে মাছ শিকার শেষে টেকনাফ ফেরার পথে মঙ্গলবার বেলা ১১টার দিকে শাহপরীর দ্বীপের নাইক্ষ্যংদিয়া নামের এলাকা থেকে ট্রলার সহ ৬ জেলেকে ধরে নিয়ে যাওয়ার তথ্য নিশ্চিত করেছেন টেকনাফ পৌরসভার কায়ুকখালীয়া ঘাট ট্রলার মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক আবুল কালাম।
টেকনাফ পৌরসভার কায়ুকখালীয়া ঘাট ট্রলার মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক আবুল কালাম বলেন, ট্রলারটির মালিক টেকনাফ পৌরসভার নাইট্যংপাড়ার বাসিন্দা মোহাম্মদ আলম । নৌযানটিতে ছয়জন মাঝিমাল্লা ছিলেন বলে তিনি জানান। তবে মাঝি আব্দুল হাফেজ। বাকি পাঁচজন জেলেদের নাম জানাতে পারেননি তিনি।
ওই ট্রলারের মাঝি আব্দুল হাফেজ সঙ্গে মুঠোফোনে কথা হয়েছে বলে জানান আবুল কালাম। তিনি বলেন, সাগরে মাছ শিকার শেষে টেকনাফে ফেরার পথে শাহপরীর দ্বীপের পূর্ব-দক্ষিণে নাফ নদী ও বঙ্গোপসাগরের মোহনা সংলগ্ন নাইক্ষ্যংদিয়া নামক এলাকায় পৌঁছালে আগে থেকেই উৎপেতে থাকা আরাকান আর্মির সদস্যরা স্পিডবোটে জেলেদের ধাওয়া করে আটক করেন। পরে তাদেরকে আটক করে মিয়ানমারের দিকে নিয়ে যাচ্ছে বলে আবুল কালামকে জানিয়েছেন ট্রলারের মাঝি আব্দুল হাফেজ। এরপর থেকে ট্রলারের মাঝিমাল্লাদের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে।
টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) শেখ এহসান উদ্দিন বলেন, ‘বিষয়টি শুনেছি। কিন্তু প্রতিদিন আরাকান আর্মির সদস্যরা বঙ্গোপসাগর থেকে ফেরারপথে বাংলাদেশি ট্রলারসহ জেলেদের অস্ত্রেরমুখে জিম্মি করে ধরে নিয়ে যাচ্ছেন। গত চারদিনে পাঁচটি ট্রলারসহ ৩৯জন জেলেকে ধরে নিয়ে গেছেন বলে ট্রলার মালিক সমিতি সূত্রে জানা গেছে।’
বিজিবি ও জেলে মালিকদের দেয়া তথ্য মতে, ২০২৪ সালের ডিসেম্বর থেকে মঙ্গলবার এই পর্যন্ত নাফ নদী ও বঙ্গোপসাগরের বিভিন্ন পয়েন্ট থেকে আরাকান আর্মি ২৫০ বাংলাদেশি জেলেকে ধরে নিয়ে গেছে। এর মধ্যে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের প্রচেষ্টায় কয়েক দফায় ১৮৯ জন জেলে এবং ২৭টি ট্রলার-নৌকা ফেরত আনা হয়েছে।
ট্রলার মালিক ও জেলেদের দাবি, টানা চারদিনে ৩৯জন জেলে আরাকান আর্মির হাতে অপহরণের শিকার হয়েছেন। আর চলতি আগস্ট মাসের ৫ আগস্ট থেকে মঙ্গলবার পর্যন্ত ২১ দিনে সাতটি ট্রলার-নৌকাসহ ৪৬ জন জেলেকে ধরে নেওয়া হয়েছে। তাঁদের কাউকে এখনো ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয়নি। টেকনাফ-সেন্ট মার্টিন নৌপথের শাহপরীর দ্বীপের পূর্ব-দক্ষিণে নাফ নদী ও বঙ্গোপসাগরের মোহনা সংলগ্ন নাইক্ষ্যংদিয়া এলাকায় বিজিবি ও কোস্টগার্ডের নজরদারি বাড়ানোর দাবি জানান তাঁরা।
ট্রলার মালিকদের দাবি, আরাকান আর্মির সদস্যরা স্পিডবোট নিয়ে নাফ নদীর বাংলাদেশের জলসীমায় ঢুকে পড়ছেন। তারা অস্ত্রের মুখে টেকনাফের জেলেসহ মাছ ধরার ট্রলার ধরে নিয়ে যাচ্ছেন। বিজিবির তৎপরতায় কিছু জেলেকে ফেরত আনা গেলেও ধরে নিয়ে যাওয়ার ঘটনা বন্ধ হচ্ছে না। এ নিয়ে তারা প্রশাসনের হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে কোস্টগার্ড টেকনাফ স্টেশনের কমান্ডার ও টেকনাফ-২ বিজিবি ব্যাটালিয়নের অধিনায়কের মুঠোফোনে একাধিকবার ফোন করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি।
নিরাপত্তা বিশ্লেষক ও গবেষক মেজর অবসরপ্রাপ্ত এমদাদুল ইসলাম জানান, আরাকান আর্মি রাখাইন রাজ্য নিয়ন্ত্রণে নেয়ার পর মিয়ানমারে থেকে বিচ্ছিন্ন রয়েছে। মিয়ানমার থেকে কোন প্রকার খাবার, পণ্য সরবরাহ করা হচ্ছে না। ফলে রাখাইনে তাদের মধ্যে খাদ্য সহ নিত্য পণ্যের তীব্র সংকট তৈরি হয়েছে। এই সংকট নিরসনে বাংলাদেশ থেকে পণ্য সংগ্রহের জন্য অর্থের প্রয়োজন রয়েছে। তাই নাফনদীতে জেলে অপহরণ ও ট্রলার লুট অর্থ আদায় বা চাঁদাবাজিকে মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করছেন। এটা বন্ধের জন্য আমাদের সীমান্ত রক্ষী বাহিনী আরও সর্তক এবং কৌশলগত অবস্থান জরুরি।
অভিবাসন ও রোহিঙ্গা বিশেষজ্ঞ গবেষক আসিফ মুনীর জানান, আরাকান আর্মি সীমান্তে তাদের কর্তৃত্বের জানান দিতে এমন একটি আচরণ শুরু করেছেন। তার নেপথ্যে কারণ কিন্তু ভিন্ন। মিয়ানমারের জান্তার সাথে আরাকান আর্মি র যে সংঘাত চলছে ওখানে রোহিঙ্গাদের জান্তার পক্ষে ঢাল হিসেবে ব্যবহারের কথা বলা হচ্ছে। এখানে রোহিঙ্গাদের আরাকান আর্মির মুখোমুখি করা হয়েছে। ওখানে রোহিঙ্গা আরও অনেকেই বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের চেষ্টা করছেন। এসব রোহিঙ্গাদের ভয়-ভীতিতে রাখার কৌশল হিসেবে নাফনদীতে আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা করছে। এব্যাপারে আমাদের আরাকান আর্মির সাথে যোগাযোগ রক্ষা করে জেলেদের নাফনদী থেকে ধরে নিয়ে যাওয়ার ব্যাখ্যা চাওয়া জরুরি।

Social Plugin